গৃহে সমৃদ্ধির আশীর্বাদে কুজাগরী লক্ষ্মী পূজ

 লক্ষী পূজার আচার নিয়ম

সনাতন ধর্ম অনুযায়ী দেবী লক্ষ্মী হচ্ছেন ধনসম্পদ, ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য, শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। দেবী লক্ষ্মীর বাহন হচ্ছেন পেঁচা। আশ্বিন মাসে দুর্গা পূজার  সাত দিন পর পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আয়োজন করা হয়। 



সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী, সকল সনাতনের বিশ্বাস করে যে এই দিনে দেবী লক্ষ্মী সকল ভক্তের ঘরে ঘরে গিয়ে পূজা নিয়ে আসেন। দেবী লক্ষী পূজা করার মাধ্যমে গৃহে সুখ ও শান্তি বজায় থাকে। লক্ষী পূজার ফলে গৃহে আয় উন্নতি বৃদ্ধি পায়। নিচে লক্ষ্মীপূজা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

পেজ সূচিপত্র 

 কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার তাৎপর্য

সনাতন ধর্ম মতে পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী সমুদ্রের মধ্যে মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মীর আবির্ভূত হন। দেবলক্ষ্মী হলেন ধন-সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী। দেবতারা তাকে স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত করলেও তিনি ভক্তদের পূজার মাধ্যমে মত লোকে এসে সকল ভক্তের গৃহে প্রবেশ করেন। স্বাস্থ্য অনুযায়ী দেবী লক্ষ্মী যেই বাড়িতে যান সেই বাড়ির সুখ শান্তি ধন-সম্পদে ভরে ওঠে। সনাতন ধর্মে আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণু দেবীর লক্ষ্মীকে মর্ত্যলোকে পাঠান মানব কুলের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য, ঠিক তখন থেকেই দেবী লক্ষ্মী জাগরণী রাতে মর্তলোকে এসে তার সকল ভক্তদের পরীক্ষা নেন। শাস্ত্র অনুযায়ী আশ্বিন মাসে পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী স্বর্গ ছেড়ে মর্তলোকে এসে চারিদিক ঘোরাঘুরি করে দেখেন কে ভক্তির সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা করছে। যারা রাত জেগে মায়ের উপাসনা করেন দেবী লক্ষী তাদের গৃহে সুখ-সমৃদ্ধি বজায় রাখা ও ধন সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বরদান করেন। 

কেন আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজা হয়

আশ্বিন মাসে পূর্ণিমা তিথিতে দেবীর লক্ষ্মী পূজার আয়োজন করা হয়। এই তিথিতে দেবী লক্ষ্যে সকল ভক্তদের গৃহে গিয়ে পূজা নিয়ে আসেন। লক্ষী পূজা করার মাধ্যমে কি পূজা করার ফলে সংসারে সুখ শান্তি ও সৌন্দর্য ধন সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আশ্বিন মাসে পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মী মর্ত্যলোকে এসে ঘুরে ঘুরে দেখেন কে তার আরাধনা রাত জেগে করছে এবং ব্রত পালন করছে। যারা দেবী লক্ষ্মীর ব্রত পালন করে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে তাদের গৃহে সুখ সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দেয়। শারদীয় দুর্গোৎসবের জাঁকজমক শেষ হওয়ার পরেই এই লক্ষ্মীপূজা আসে। শারদীয়া দুর্গোৎসব সামাজিক পূজা হলেও লক্ষী পূজা হচ্ছেন পারিবারিক। এটি সকল সনাতনীদের বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা পালন করা হয়। 

দেবী লক্ষ্মী পূজার পেছনে পৌরাণিক কাহিনী

লক্ষী পূজার পেছনে এক বা একাধিক পৌরানিক কাহীনি আছে। সনাতন ধর্মের পুরাণ অনুযায়ী উল্লেখ্য আছে যে দেবী লক্ষ্মী হচ্ছেন ভগবান বিসুর সহধর্মিনী। তিনি সর্বদাই বিষ্ণুদেবের বুকে বহন করে এবং ভক্তদের কল্যাণের জন্য সাধন করেন। সকল ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে দেবী লক্ষীর কৃপায় সংসারের সুখ শান্তি ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়। দেবী লক্ষ্মী পূজার পেছনে সবচেয়ে সুপরিচিত কাহিনী হলেও সমুদ্রমন্থন। সমুদ্র মন্থন বলতে দেবতা ও অসুররা যখন অমৃত লাভের জন্য মন্দার পর্বত ও বাস্কি নাগ ক্ষীরসাগর মন্থন করতে থাকে। সমুদ্রমন্থন চলাকালীন অনেক মূল্যবান রত্ন সোনার গয়না ও দেবীর বস্ত্র বের হয়, ঠিক তার কিছুক্ষণ পর থেকে সোনার পদ্ম ফুল থেকে আবির্ভূত হন দেবী লক্ষ্মী। তাই কোজাগরি লক্ষ্মী পূর্ণিমায় ভক্তরা শুধু দেবীকে আহবান করেন না তাদের নিজের দেহ শুদ্ধ ও সৎ হিসেবে গড়ে তোলে।

গৃহে আয় উন্নতির সাথে লক্ষ্মীপূজার সম্পর্ক

দেবী লক্ষ্মী হচ্ছে ধনসম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী । সনাতন ধর্ম অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় তিনি সৎ পরিশ্রম যেই ভক্তের ওপর সন্তুষ্ট হন তার জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট দূর করে এবং তার সংসারে আনন্দ সুখ শান্তি ও ধন সম্পদে ভরিয়ে দেয়। দেবী লক্ষ্মী সেই গৃহে বিরাজ করে যে গৃহে সততা , সদ পরিশ্রম ও ভক্তি  রয়েছে। যেন এই নৈতিক শিক্ষা মানুষকে জীবন নিয়ে সৎ পরিশ্রম ও সত্যের সঙ্গে উপার্জন করতে পারে সেই দিকে তাদের চলার পথ দেখায়। তাই গৃহে আয় বৃদ্ধি ও ব্যবসার সাফল্যের জন্য লক্ষী পূজা করা হয়। তবে লক্ষী পূজার পূর্ণিমা আশ্বিন মাসে  কোজাগরী তিথিতে পড়ে। 

লক্ষ্মী পূজার প্রয়োজনও দ্রব্য সামগ্রী ও প্রস্তুতি

লক্ষী পূজা করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু উপকরণ ও সঠিক প্রস্তুতি নেওয়া খুবই জরুরী। কারণ পূজার সামগ্রী ও আচার অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পালন হলে আশীর্বাদ অর্জন করা যায়। লক্ষ্মী পূজা করার জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয় হলো প্রতিমা কিংবা দেবলক্ষ্মীর ছবি। যে লক্ষ্মীর মূর্তি কিংবা ছবি  মন্ত্রের  সাহায্যে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় তারপর লক্ষ্মীকে উৎসর্গ করে ভোগ নিবেদন করা হয়। মাটি কিংবা পিতলের কলস দিয়ে ঘট স্থাপন করা হয়। এই ঘটের মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষী পূজার দিন আলপনা দিয়ে ঘর সাজানো হয়। মাটি কিংবা পিতলেরে প্রদিপ জালিয়ে ধুপ ধুন জালানো হয় প্রিবেশ পবিত্র রাখার জন্য। পূজার সময় অবশ্যই ফুন,বেল্পাতা,তুলশিপাতা,ধান,দুধ,খই, সিঁদুর, হলদি, চন্দন, কুমকুম, নারকেল ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। পূজার আগে ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বিশেষ করে বাড়ির উঠান রান্নাঘর ও মূল দরজা পরিষ্কার রাখা হয়। যাদের বাসায় মাটির উঠান আছে তারা গোবর জল দিয়ে গোটা উঠানো শুদ্ধ করে নেয়। পূজার আগে উপবাস বা নিরামিষ ভোজ অনেকেই পালন করে  থাকন।

দেবী লক্ষ্মী পুজার সকল আচার নিয়ম

লক্ষী পূজা করার জন্য অনেক আযার নিয়ম পালন করতে হয়, এই আচার নিয়ম পালন করা সনাতনীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষী পূজার আচার-নিয়ম প্রাচীনকাল থেকে পালিত হয়ে আসছে বিশ্বাস করা হয় আচার নিয়ম মেনে পূজা করলে দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভ হয়। এই দিন গোটা গৃহ গঙ্গাজল অথবা গোবর জল দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। যাতে কোন অশুভ শক্তি বাড়ির আশেপাশে ভিড়তে না পারে। লক্ষ্মী পূজার সময় বাড়ির মেয়েরা উপাস থাকে ও লক্ষী পূজার ব্রত পালন করে। একটি ঘটে গঙ্গাজল আমের শাখা ও একটি  ডাব দিয়ে ঘট উপস্থাপন করে। এই ঘর উপস্থাপন করার মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।

উপবাস ও ব্রত পালনের নিয়ম

লক্ষ্মী পূজার সময় শুধুমাত্র আচার পালন করাই নয়, প্রকাশ ও ব্রত রাখতে হয়। সনাতন ধর্ম অনুসারে বিশ্বাস করা হয় এই নিয়ম পালন করলে দেবী লক্ষী সন্তুষ্ট হয়ে পরিবারের সুখ শান্তি ধন-সম্পদ ভরিয়ে দেয়। লক্ষী পূজার সময় উপবাস ও ব্রত পালন করা খুবই জরুরী। পূজার দিন ভোর বেলায় উঠে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নতুন জামা কাপড় পড়তে হয়। জিবি লোকের উদ্দেশ্যে মনে মনে সংকল্প করতে হয়। দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি অথবা ঘটে সামনে বসে তে ফুল জল নিয়ে ব্রত পালন করতে হয়। ব্রতর মূল উদ্দেশ্য হবে ভক্তি দেবীকে সন্তুষ্ট করে গৃহ সমৃদ্ধির কামনা। লক্ষ্মী পূজার ব্রত পালন করতে হলে  সারাদিন নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

বসতবাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার ফল ও উপকারিতা

মানব জীবনের লক্ষ্মী পূজা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করা হয় সুচি ভক্তি সহকারে বসত বাড়িতে লক্ষ্মী পূজার আয়োজন করলে সেখানে দেবী লক্ষী নিজে উপস্থিত থাকেনএবং ধন-সম্পদ সুখ সান্তি দান করেন। লক্ষী পূজা করলে পারিবারিক আই বৃদ্ধি পায়, ও সকল ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার দূর হতে শুরু করে। মায়ের পুজো ভক্তি ভরে করলে সকল ঋণ অভাব অনটন থেকে মুক্তি মিলে। আবার কৃষকরা ধান কাটার আগে দেবী লক্ষীর পূজা করেন। 

শুভ অশুভ লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা

প্রাচীনকাল থেকেই অনেক মানুষ শুভ অশুভ অশরীয় কে অনেকটা গুরুত্ব দিয়ে আসছে। স্বাস্থ্য, পুরান অনুযায়ী মানুষ বিশ্বাস করে যে কিছু ইঙ্গিত শুভ বা অশুভোর লক্ষ্য হিসেবে জানান দেয়। সংসার ধর্ম পালন করার জন্য কিছু শুভ-অশুভ লক্ষ্যন আছে। যেমন ধরেন পুরুষদের ক্ষেত্রে ডান চোখ নারীদের ক্ষেত্রে বাম চোখ ফরফরানো করা শুভ লক্ষণ বলে মানা হয়। আবার অনেক মানুষ এটা মনে করে অতিথি নারায়ন। আপনি যদি অতীতে সেবা করেন তাহলে নারায়ণ সেবা করা হয়ে যায়। বাট আবার বাড়ির আশেপাশে বা ছাদে কাক যদি বারবার ডাকে তাহলে সেটাকে অশুভ ইঙ্গিত বলে মানা হয়.

লেখকের শেষ কথা

আশ্বিন মাসে যে কোজাগরি লক্ষী পূজা হয় তা শুধু পূজায় নয় বরং এটি শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রতি হিসেবে ধরা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে অনেক মহিলারা দেবীকে আহবান করে প্রার্থনা করে যাতে তাদের সংসারের সুখ শান্তি বজায় থাকে। ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে দেবী লোকের আরাধনা করলে তিনি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকেন এবং আপনাকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন। উপরোক্ত যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো তা লক্ষীপূজার সময় অবশ্যই কাজে লাগবে এবং সকল নিয়মকানুন ঠিকভাবে মেনে চলতে হবে তবে দেবী লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হয়ে আপনাকে বরদান করবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url